বাংলার বর্ষা ও নারী সৌন্দর্যের মধ্যে যে আধ্যাত্মিক ও সাহিত্যিক সেতুবন্ধন গড়ে উঠেছে, তার একটি বিস্ময়কর দিক হলো — ‘কাদামাটির সঙ্গে নারীর রূপসজ্জার সম্পর্ক’। কাদামাটি গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে কেবল কৃষির উপকরণ নয়; বরং তা নারীদেহের শোভা, শৃঙ্গার এবং পবিত্রতার এক প্রতীক। ভারতীয় সাহিত্য–ইতিহাসে বর্ষার কাদা ও নারীর দেহ এক সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে প্রেম, উর্বরতা এবং সৌন্দর্যের রূপক হিসেবে।
প্রাচীন বেদ–উপনিষদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিতা, বাংলা লোকসংস্কৃতি ও আধুনিক কবিদের কবিতায় নারীর সৌন্দর্য বর্ণনার সময় বারবার কাদামাটির ছোঁয়া এসে পড়েছে। বর্ষার প্রথম বৃষ্টির জলে ভিজে কাদা হওয়া মাটির সঙ্গে নারীর রূপসজ্জা এমনভাবে মিশেছে যে, তা কেবল রূপকল্প নয়, বাস্তব সংস্কৃতিরও অংশ।
রূপসজ্জা একটি বহুমাত্রিক মানবিক ও সাংস্কৃতিক আচরণ। নারীর সৌন্দর্যচর্চা কেবল শারীরিক সৌন্দর্যের প্রকাশ নয়, বরং সামাজিক পরিচয়, আধ্যাত্মিকতা ও আত্মপ্রকাশেরও উপায়। এ ক্ষেত্রে মাটি বা কাদা, যা পৃথিবীর মূল উপাদান, বরাবরই বিশেষ স্থান অধিকার করেছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে বর্ষাকাল, নদীর কাদা ও উর্বর মাটি নারীর রূপসজ্জায় স্থান পেয়েছে আচার, সাহিত্য ও লোকাচারে। এটি কেবল ভারতেই নয়, আফ্রিকা, প্রাচীন মিশর ও আমেরিকার দেশীয় সংস্কৃতিতেও দেখা যায়। Raise Your Concern About this Content
ভারতীয় প্রেক্ষাপট
বৈদিক ও প্রাক–শাস্ত্রীয় যুগ
ঋগ্বেদ (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০–১২০০)–এ নদী ও মাটিকে নারীসুলভ, উর্বর ও শোভাময় বলা হয়েছে। ১০.৭৫ মণ্ডলে নদী ও তার পঙ্ককে সুন্দরী কুমারীর রূপক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
– বিয়ের আগে বর্ষার কাদা ও নদীর তীরের মাটি গায়ে মাখিয়ে নারীর শুদ্ধতা ও উর্বরতা কামনা করা হতো (ঋগ্বেদ ১০.৮৫)।
অথর্ববেদ–এ বলা হয়েছে, পবিত্র মাটি ত্বককে শীতল ও উজ্জ্বল রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ করে।
বৌদ্ধ ও মধ্যযুগীয় সাহিত্য
বৌদ্ধ জাতক কথা (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৩–২ শতক)–তে বর্ণিত আছে যে, বর্ষায় উৎসবের সময় মেয়েরা নদীর তীরে কাদা মেখে নৃত্য করত।
চর্যাপদ (প্রায় ৯৫০–১২০০)–এ কাদা ও মাটিকে নারীদেহের সঙ্গে একাকার করা হয়েছে:
“কায়া মাটি হইল পঙ্কিলা” — অর্থাৎ নারীদেহ মাটির মতো পঙ্কিল হয়ে প্রেমাসক্ত।
গীতগোবিন্দ–এ (প্রায় ১২০০) রাধার কাদা মাখা পায়ের বর্ণনা আছে:
“পঙ্কিল পদপদ্মা” — কাদা মেখে পা আরও মাধুর্য পেয়েছে।
বাংলা লোকসংস্কৃতি ও আধুনিক সাহিত্য
বাংলায় গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে এখনও বর্ষার মাটি ও হলুদ মিশিয়ে নববধূকে শোভিত করা হয়।
গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা মাটি (মুলতানি মাটি, নদীর কাদা) দিয়ে রূপচর্চা করেন।
রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের কবিতায় নারীর সৌন্দর্য ও বর্ষার কাদা মাটির সমন্বয় রূপক হিসেবে এসেছে:
“কাদার মতো মাটির মতো সে এলো…” (জীবনানন্দ)
আফ্রিকা
নামিবিয়ার হিম্বা ও হেরেরো নারীরা ত্বক ও চুলে ওতজিজে নামে লাল মাটি ও চর্বির মিশ্রণ ব্যবহার করেন। এটি সৌন্দর্য, সূর্য থেকে সুরক্ষা এবং সামাজিক পরিচয় প্রকাশ করে। পশ্চিম আফ্রিকার বহু উপজাতি সাদা (কায়োলিন), লাল বা হলুদ মাটি দিয়ে ত্বক শোভিত করে।
প্রাচীন মিশর
মিশরের নারীরা নীল ও নীল–ধূসর নাইল নদীর মাটি দিয়ে মুখের পরিচর্যা করতেন, যা ত্বককে কোমল ও উজ্জ্বল রাখে। দেবী হাথোরের পূজায়ও নারীরা মাটি মেখে উৎসবে অংশ নিতেন।
আদিবাসী আমেরিকা
উত্তর আমেরিকার হোপি ও চেরোকি নারীরা রঙিন মাটি দিয়ে মুখ ও শরীর রঙ করতেন, যা উত্সব ও আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ করত।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ
– পলিনেশিয়ান নারীরা আগ্নেয় মাটি ও সাদা প্রবালের গুঁড়ো মিশিয়ে রূপসজ্জা করতেন, যা শীতলতা ও সৌন্দর্যের প্রতীক।
মাটি ও নারীর সম্পর্ক একটি বিশ্বজনীন ধারণা। ভারতে এটি বর্ষা ও উর্বরতার সঙ্গে যুক্ত; আফ্রিকায় এটি পরিচয় ও সূর্য–সুরক্ষার সঙ্গে; মিশরে যৌবন ও স্বাস্থ্য রক্ষার সঙ্গে এবং আমেরিকার উপজাতিদের কাছে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে। ভারতীয় সাহিত্য এটিকে রূপক ও আচার দু’ভাবে ব্যবহার করেছে, যেখানে বিদেশি সংস্কৃতিতে তা আরও দৃশ্যমান দৈনন্দিনতার অংশ।
‘মাটি’ নারীর রূপসজ্জায় আধ্যাত্মিক, শারীরিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বহন করে। ভারতীয় সাহিত্য ও লোকাচারে এর ব্যঞ্জনা রূপক ও বাস্তব—দুটিই। বৈদিক যুগের কুমারী থেকে শুরু করে রবীন্দ্র–জীবনানন্দের নারীরা এবং আফ্রিকার হিম্বা নারী—সবাই মাটির সঙ্গে নিজেদের সৌন্দর্য ও পরিচয়কে মিলিয়ে একাকার করেছেন।
তথ্যসূত্র
- আশুতোষ ভট্টাচার্য: বাংলার লোকসংস্কৃতি
- সুকুমার সেন: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
- দীনেশচন্দ্র সেন: বৃহৎ বাংলার সাহিত্য
- তারাপদ সাঁতরা: বাংলার লোকরীতি ও আচার অনুষ্ঠান
- আশুতোষ ভট্টাচার্য: বাংলার লোকসংস্কৃতি
- অজিতকুমার মুখোপাধ্যায়: বাংলার গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতি
- Dube, S.C. Indian Folk Rituals and Culture. Bombay: Popular Prakashan, 1951.
- Dutt, Kalpana. The Cultural History of Indian Cosmetics and Adornment. New Delhi: Munshiram Manoharlal Publishers, 2003.
- Pant, Pushpesh. Beauty and Body Care in Ancient India. New Delhi: Aryan Books, 1992.
- Fletcher, Joann. The Story of Cosmetics in Ancient Egypt. London: British Museum Press, 1995.
- Gröning, Karl. Body Decoration: A World Survey of Body Art. London: Thames & Hudson, 1997.
- Jacobson-Widding, Anita. Red–White–Black as a Mode of Thought: A Study of Triadic Symbolism. Stockholm: Almqvist & Wiksell International, 1990.