মানুষ চিরকালই আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছে—কখনো ঈশ্বরের সন্ধানে, কখনো ভবিষ্যতের ইঙ্গিতে, আর কখনো বা কেবল কৌতূহলের বশে। যুগে যুগে, সভ্যতা থেকে সভ্যতায়, মানুষের একটি প্রশ্ন বদলায়নি—“আমরা কি এই মহাবিশ্বে একা?”
এই প্রশ্ন শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞান বা দার্শনিক চিন্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজন। নিজেকে চিনতে হলে, ‘অন্য’র অস্তিত্ব অন্বেষণ করতে হয়। তাই তো মানুষ শুধু নিজের চারপাশ নয়, মহাবিশ্বের গভীরতর স্তরেও খোঁজে এমন কাউকে—যারা আমাদের চেয়ে উন্নত, বুদ্ধিমান, কিংবা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জৈব-প্রকৃতি থেকে আসা সত্তা। Raise Your Concern About this Content
এখানেই আসে ভিনগ্রহী (Alien) ও অজানা উড়ন্ত বস্তু (UFO)-র প্রসঙ্গ। UFO মানে Unidentified Flying Object—অর্থাৎ এমন একটি বস্তু, যা আকাশে দেখা গেলেও তার সঠিক পরিচয় বা উৎস জানা যায়নি। কেউ বলেন ওগুলো নতুন প্রজাতির প্রাণী বহন করে, কেউ বলেন তারা ভবিষ্যতের সময়ভ্রমণকারী, আবার কেউ বলেন এগুলো স্রেফ মানুষের বিভ্রম বা প্রযুক্তিগত ভুল ব্যাখ্যা।
তবে এই কল্পনা আর বিভ্রান্তি জুড়ে বসে আছে বাস্তব এক দিবস—২রা জুলাই: বিশ্ব ইউএফও দিবস (World UFO Day)। এই দিনটিকে ঘিরে বিজ্ঞানমনস্ক, ষড়যন্ত্রতত্ত্বপ্রেমী এবং কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্যানুরাগীরা একত্র হন অজানার সম্ভাবনার উদযাপনে।
বিশ্ব ইউএফও দিবসের উদ্দেশ্য দুইটি—
১. জনগণকে ভিনগ্রহী প্রাণীর সম্ভাব্য অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করা
২. সরকার যেন সমস্ত ইউএফও তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করে, সেই দাবি জোরালো করা
বিজ্ঞান যদি হয় গবেষণার ফল, তবে কল্পনা হয় তার জন্মদাত্রী। এই সমন্বয়ের সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ পাওয়া যায় সাহিত্যে, বিশেষত বাংলা সাহিত্যে সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু চরিত্রে।
শঙ্কুর কাহিনি শুধুমাত্র এক প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর আবিষ্কার নয়, বরং সেখানে রয়েছে একটি গভীর দর্শন—যেখানে ভবিষ্যতের বিজ্ঞান, কল্পনার রাজ্য, মনস্তত্ত্ব ও বাস্তবের সীমারেখা এক অদ্ভুত সৌন্দর্যে মিশে যায়।
২রা জুলাই: UFO দিবসের প্রেক্ষাপট
রসওয়েল (Roswell), নিউ মেক্সিকো, ১৯৪৭
এই বছরের ২ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রসওয়েলে একটি ‘উড়ন্ত বস্তু’ ভেঙে পড়ে। প্রথমে একে “flying saucer” হিসেবে প্রচার করা হলেও পরে সেনাবাহিনী বলেছিল তা একটি আবহাওয়ার বেলুন।
তবে এই ঘটনাই ‘UFO কনসপিরেসি থিওরি’-র জন্ম দেয়। এবং ২০০১ সালে হাকান একদোমগ্লু নামে এক গবেষক এই দিনটিকে World UFO Day ঘোষণা করেন।
আপনি কি ভিনগ্রহীদের বিশ্বাস করেন?
এই প্রশ্নটি শুধু কল্পনা বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিষয় নয়। এটি এক দার্শনিক জিজ্ঞাসাও বটে।
কার্ল সেগান তাঁর Cosmos বইতে লিখেছেন—
“The universe is a pretty big place. If it’s just us, seems like an awful waste of space.”
অন্যদিকে Stephen Hawking সতর্ক করে বলেছিলেন—
“Meeting a more advanced alien civilization could be like Native Americans encountering Columbus. That didn’t turn out so well for them.”
বাংলা সাহিত্যে ইউএফও ও ভিনগ্রহীর অনুসন্ধান
প্রফেসর শঙ্কু – সত্যজিৎ রায়
সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু একজন রেনেসাঁসপ্রিয় বিজ্ঞানী, যার চরিত্র নির্মাণে রয়েছে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনার সঙ্গে বাঙালি বুদ্ধিজীবীর সংবেদনশীলতা।
“শঙ্কু ও UFO” গল্পে প্রথমবার শঙ্কু সরাসরি এলিয়েন বা ভিনগ্রহী প্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলেন।
এই গল্পে তিনি একটি অজানা মহাকাশযানের মুখোমুখি হন—যা বৈজ্ঞানিক যুক্তির বাইরে গিয়েও ব্যাখ্যার দাবি তোলে।
“আমি জানি না ওরা কারা, কোথা থেকে এসেছে, কী চায়। কিন্তু এটুকু বুঝেছি—এই মহাবিশ্বে আমরা একা নই।”
এই একটি লাইনেই শঙ্কুর ভাবনা ও কল্পনার বিজ্ঞানমনস্কতা ধরা পড়ে।
প্রফেসর শঙ্কুর বৈজ্ঞানিক মনন ও বাস্তব বিজ্ঞান
- শঙ্কুর বিজ্ঞানচর্চা কাল্পনিক হলেও বহু ক্ষেত্রেই তার ভিত্তি ছিল যুক্তিনির্ভর বাস্তব বিজ্ঞানে।
- গল্পে “মিরাকিউরল”, “অ্যানাইহিলিন পাউডার”, “ম্যাগনেটিক ডিটারজেন্ট”—সবই আসলে অত্যাধুনিক গবেষণার প্রতিফলন।
- এলিয়েনদের সঙ্গে যোগাযোগ বা তাদের অস্তিত্ব অনুমানের বিষয়টি বাস্তব বিজ্ঞানীদের গবেষণার সঙ্গে মিল খায় (যেমন: SETI, NASA’s UAP projects)।
শঙ্কুর মনোভাব Carl Jung-এর Collective Unconscious ও Archetypes-এর চিন্তার সঙ্গে মিলে যায়। তিনি বিশ্বাস করেন পৃথিবীর বাইরে এমন কিছু আছে, যা মানববুদ্ধি এখনো বুঝে উঠতে পারেনি।
আন্তর্জাতিকভাবে প্রাসঙ্গিক বইয়ের নাম (Alien/UFO বিষয়ে)
- “The War of the Worlds” – H.G. Wells
- “Childhood’s End” – Arthur C. Clarke
- “Contact” – Carl Sagan
- “The Three-Body Problem” – Liu Cixin
- “UFOs: Generals, Pilots, and Government Officials Go on the Record” – Leslie Kean
চলচ্চিত্রে ভিনগ্রহীর ছায়া
- Interstellar – ভিন্ন গ্রহে মানবসভ্যতার ছড়িয়ে পড়া ও আত্মজিজ্ঞাসা
- Nope (2022) – UFO ও সামন্তবাদী মনোবৃত্তির দৃষ্টিকোণ
- Independence Day – ক্লাসিক ভিনগ্রহী আক্রমণ ও মানবজাতির প্রতিরোধ
সংশ্লিষ্ট গবেষণা ও তথ্য
- SETI (Search for Extraterrestrial Intelligence): রেডিও সংকেতের মাধ্যমে ভিনগ্রহীর খোঁজ
- NASA’s UAP Task Force (2021): ১৪৩টি UFO রিপোর্ট ব্যাখ্যাহীন
- James Webb Space Telescope (JWST): দূরবর্তী গ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রাণের চিহ্ন খোঁজার চেষ্টা
“বিশ্বাস” যদি কল্পনার একটি রূপ হয়, তবে বিজ্ঞান তার যুক্তিনিষ্ঠ কাঠামো। প্রফেসর শঙ্কুর মত চরিত্র আমাদের শেখায়—
“কল্পনা করাই প্রথম ধাপ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা তার দ্বিতীয়, এবং প্রশ্ন তোলা হলো জ্ঞানের মূল স্তম্ভ।”
ভিনগ্রহী প্রাণীর অস্তিত্বের ধারণা আজও বিতর্কিত, কিন্তু সাহিত্য ও বিজ্ঞান এই বিষয়ে বারবার ফিরে আসে— কারণ এটা শুধুই একটি রহস্য নয়, এটা আমাদের অস্তিত্বের পরিধি প্রসারিত করার আকাঙ্ক্ষা।
তথ্যসূত্র:
- সত্যজিৎ রায় – শঙ্কু সমগ্র, আনন্দ পাবলিশার্স
- Carl Sagan – Cosmos, Random House
- H.G. Wells – The War of the Worlds
- Arthur C. Clarke – Childhood’s End
- অনীশ দেব– মানুষ ও অমানুষ
- সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় – অন্য জগতে
- অমল চট্টোপাধ্যায় –বিজ্ঞানের গল্পে গল্পে ভিনগ্রহী