27 C
Kolkata
Wednesday, 17 September, 2025

Buy now

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

মহাশ্বেতা দেবীর লেখায় বাস্তবতার সংলাপ

মহাশ্বেতা দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯২৬ সালে, এক সাহিত্যিক পরিবারে। তার বাবা মনীষ ঘোষ, মা ধীরানী দেবী—দুজনেই সাহিত্যিক। কিন্তু সাহিত্যজগতে প্রবেশের পরপরই তিনি বোঝেন, তাঁর লেখার উদ্দেশ্য কেবল নান্দনিকতা নয়। বরং তা হওয়া উচিত সমাজের উপেক্ষিত ইতিহাসের পুনর্লিখন। স্বামী বিজন ভট্টাচার্য এবং পুত্র নবারুণ ভট্টাচার্য দুজনেই ছিলিম খ্যাটিনামা নাট্যকার সাহিত্যিক কবি।

ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েও তিনি ছুটে গেছেন কোথাও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটলে, আবার কখনও শবর, খেড়িয়া, লোধা সম্প্রদায়ের উপর অন্যায় হলে। এই জনগোষ্ঠী তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করত—এই সম্পর্কের বিশ্লেষণ ভবিষ্যতের কাছে হয়তো রহস্যই থেকে যাবে।

“আমার লেখার কারণ ও অনুপ্রেরণা হল সেই মানুষগুলি যাদের পদদলিত করা হয় ও ব্যবহার করা হয়, অথচ যারা হার মানে না। আমার কাছে লেখার উপাদানের অফুরন্ত উৎসটি হল এই আশ্চর্য মহৎ ব্যক্তিরা, এই অত্যাচারিত মানুষগুলি। অন্য কোথাও আমি কাঁচামালের সন্ধান করতে যাব কেন, যখন আমি তাদের জানতে শুরু করেছি? মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার লেখাগুলি আসলেই তাদেরই হাতে লেখা।”

মহাশ্বেতা দেবী বহুবার ভারতের উপজাতি মানুষদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। ২০১৬ সালের জুন মাসে মহাশ্বেতা দেবীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঝাড়খণ্ড সরকার বিশিষ্ট আদিবাসী নেতা বিরসা মুন্ডার একটি মূর্তিকে শৃঙ্খলামুক্ত করে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের শাসনকালে গৃহীত শৃঙ্খলিত বিরসা মুন্ডার একটি আলোকচিত্রের ভিত্তিতে মূর্তিটি নির্মিত হয়েছিল। বিরসা মুন্ডার জীবনকাহিনি অবলম্বনে ১৯৭৭ সালে মহাশ্বেতা দেবী অরণ্যের অধিকার উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন।

লেখিকা গল্প ও উপন্যাসে নিচ শ্রেণির কথাই তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন বক্তব্যেও তাই করেছেন। তাঁর ছিল অকৃত্রিম দেশপ্রেম। নিজের অবস্থানের কথা চিন্তা না করে লিখেছেন সাধারণের নিয়ে। ২০০৬ সালে ফ্রাঙ্কফুট বইমেলায় ভারত দ্বিতীয় বারের জন্য অতিথি দেশ নির্বাচিত হয়। মেলার উদ্বোধনী ভাষণে মহাশ্বেতা দেবী রাজ কাপুরের বিখ্যাত চিত্রগীতি ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’ থেকে পংক্তি উদ্ধৃত করে একটি আবেগময় ভাষণ দেন-

"সত্যই এটি এমন এক যুগ যেখানে 'জুতাটি (জুতো) জাপানি, 'পাতলুন'টি (প্যান্ট) 'ইংলিশস্তানি' (ব্রিটিশ), টোপি'টি (টুপি) 'রুসি' (রাশিয়ান), কিন্তু 'দিল'... দিল'টি (হৃদয়) সর্বদা 'হিন্দুস্তানি' (ভারতীয়)... আমার দেশ, ক্ষয়প্রাপ্ত, ছিন্নভিন্ন, গর্বিত, সুন্দর, উষ্ণ, আর্দ্র, শীতল, ধূলিধূসরিত, উজ্জ্বল ভারত। আমার দেশ।”

মহাশ্বেতা দেবী প্রতিবাদী জীবন ও সাহিত্যের এক স্বতন্ত্র ঘরাণার লেখক। তাঁর লেখায় বহুমাত্রিক অনুষঙ্গে দেশজ আখ্যান উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি একজন অনুসন্ধানী লেখক। তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ইতিহাসের উপেক্ষিত নায়কদেরকে তুলে এনেছেন তাঁর গল্প ও উপন্যাসে। এ প্রসঙ্গের জ্বলন্ত উদাহরণ তাঁর লেখা’অরণ্যের অধিকার’, ‘চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর‘, ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাস। ‘অরণ্যের অধিকার‘ উপন্যাসের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, –লেখক হিসাবে, সমকালীন সামাজিক মানুষ হিসাবে একজন বস্তুবাদী ঐতিহাসিকের সমস্ত দায় দায়িত্ব বহনে আমরা সর্বদাই অঙ্গীকারবদ্ধ। দায়িত্ব অস্বীকারের অপরাধ সমাজ কখনোই ক্ষমা করে না। আমার বীরসা কেন্দ্রিক উপন্যাস সে অঙ্গীকারেরই ফলশ্রুতি। স্বাধনী ভারতে বসবাস করে পরাধীন ভারতের ইতিহাস লিখেছেন বীরসার উলগুলনের তাৎপর্যময় ব্যাখ্যা করে। তিনি দেখতে পান স্বাধীন ভারতেও মুন্ডারা ভূমিহীন তাই তিনি ইতিহাসের মাঝ দিয়ে তাদের দিয়ে জাগাতে চান।Raise Your Concern About this Content

  • নারীবাদী সাহিত্য:
    দোপদি, সুজাতা বা অন্যান্য চরিত্ররা নারী হিসেবে শুধু অবহেলিত নয়, বরং তারা সমাজকে পাল্টে দেওয়ার প্রতিরোধী মুখ।
  • আদিবাসী ও নিম্নবর্গ:
    সাঁওতাল, মুন্ডা, খেড়িয়া—তাঁদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরার ক্ষেত্রে মহাশ্বেতা দেবী ছিলেন একক কলমযোদ্ধা।
  • রাষ্ট্রবিরোধী চেতনা:
    তাঁর লেখায় স্পষ্ট রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বার্তা পাওয়া যায়। এটি নিছক সাহিত্য নয়, একটি রাজনৈতিক অবস্থান।
  • ভাষা ও উপস্থাপনা:
    সহজ, সরল ভাষায় নির্মম সত্য। কোনো অলংকারের আড়ালে তিনি সত্য লুকাননি।
লীলা মজুমদারের উক্তি -
"মহাশ্বেতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে হয়, ওর জীবনটা যেন দুঃখের ইট দিয়ে গড়া। সেই কারণেই দেশের নানা দুঃখী মানুষদের মর্মবেদনা তিনি এমনভাবে বুঝেছিলেন ও তাদের জীবনচিত্র আঁকতে পেরেছিলেন।"


এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট যে মহাশ্বেতার লেখালেখির মূল প্রেরণা ছিল দুঃখ ও দুঃখী মানুষের প্রতি একধরনের গা-জড়িয়ে-থাকা সহানুভূতি। তাঁরা তাঁর কাছে কাহিনির বিষয় নয়, আত্মার আত্মীয়।

মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্য আমাদের শেখায়—লেখার উদ্দেশ্য কেবল ভাষার সৌন্দর্য নয়, বরং সত্যকে তুলে ধরা, যে সত্য অনেক সময় রাষ্ট্র ও সমাজ লুকিয়ে রাখতে চায়। তাঁর লেখা শুধুই প্রতিবাদ নয়, তা ইতিহাসের বিকল্প রূপায়ণ, যেখানে ‘অভাগাদের’ কণ্ঠস্বর শোনা যায়। বাস্তবায়নের এই সাহিত্যের একক প্রবক্তা হিসেবে তাঁর স্থান বাংলা সাহিত্যে অনন্য ও অমোচনীয়।

তথ্যসূত্র: 

Avatar photo
+ posts

সম্পাদনা, সাংবাদিকতা, এবং সৃজনশীল লেখায় প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা নিয়ে অদিতি এক উদীয়মান সাহিত্যিক কণ্ঠ। বাংলা সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং সুগভীর প্রতিভার অধিকারী এক তরুণ লেখিকা। বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করে, নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকা, ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল এবং সংকলনে তার লেখা প্রকাশ হয়েছে। তার লেখা একক বই এবং সম্পাদিত সংকলন কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে, তার “মৃত্যু মিছিল” বইটি পাঠকমহলে বেশ জনপ্রিয়। তার সৃষ্টিশীলতার প্রসার ঘটেছে আকাশবাণী এবং ফ্রেন্ডস এফএম-এ, যেখানে তার লেখা সম্প্রচারিত হয়েছে। অদিতির মতে, "বইয়ের থেকে পরম বন্ধু আর কেউ হয় না," এবং এই বিশ্বাস তাকে সাহিত্য জগতে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে চলেছে। বর্তমানে তিনি “বিশ্ব বাংলা হাব” -এ লেখক পদে কর্মরত।

- বিজ্ঞাপন -

প্রাসঙ্গিক

সাথে থাকুন

110FansLike
105FollowersFollow
190SubscribersSubscribe
- বিজ্ঞাপন -
- বাংলা ক্যালেন্ডার -
- বিজ্ঞাপন -spot_img

সাম্প্রতিক