‘ভাষা’ কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়। মাতৃভাষা আমাদের ভাব, অনুভূতি ও চিন্তার সর্বাধিক স্বাভাবিক প্রকাশভঙ্গি। বাংলা ভাষা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা এবং প্রায় ২৬ কোটি মানুষের মাতৃভাষা। এ ভাষার সাহিত্যিক ঐতিহ্য হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো—চর্যাপদ থেকে শুরু করে আধুনিক সাহিত্য পর্যন্ত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা যায়, বাংলা ভাষা ব্যবহারে এক ধরনের অনিয়ম, বিকৃতি ও অবহেলা বেড়ে চলেছে। এর ফলে সঠিক লেখ্যরূপ এবং কথ্যরূপের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।“সঙ্গে” ও “সাথে”-র ব্যবহার নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক আসলে সেই বৃহত্তর সংকটেরই প্রতিফলন।
পার্থ ভট্টাচার্যের উদ্যোগ

আমেরিকার নিউ জার্সিতে বসবাসরত পার্থ ভট্টাচার্য, একজন প্রবাসী বাঙালি ও পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তিনি লক্ষ্য করেন, কলকাতার রাস্তাঘাট, দোকানপাট ও জনজীবনে “সাথে” শব্দের অতি-ব্যবহার হচ্ছে, যেখানে শুদ্ধ রূপটি হওয়া উচিত “সঙ্গে”। এই ভুল শুধু সাধারণ মানুষ নয়, শিক্ষিত সমাজের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। ২০২১ এর দুর্গাপূজার সময় কলকাতার বিভিন্ন স্থানে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যানার টাঙান, যাতে লেখা ছিল—
“সাথে নয়, সঙ্গে বলুন”
ব্যানারগুলি গোলপার্ক, কলেজ স্ট্রিট, গড়িয়াহাট প্রভৃতি জনবহুল এলাকায় টাঙানো হয়। সামাজিক মাধ্যমে এই ছবি ভাইরাল হলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। অনেকেই একে অভিনব উদ্যোগ বলে প্রশংসা করেন, আবার কেউ কেউ এটিকে ভাষা-আন্দোলনের অতি-সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া হিসেবেও সমালোচনা করেন। তবে নিঃসন্দেহে, প্রবাস থেকে এমন ভাষা-সচেতনতার দৃষ্টান্ত বিরল।
ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
১. ব্যাকরণগত দিক
- “সঙ্গে” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “সহ” (অর্থাৎ সাথে থাকা) থেকে।
- বাংলা ব্যাকরণে মান্য রূপ “সঙ্গে”—যা কাউকে বা কিছুকে নিয়ে চলা বা থাকা বোঝায়।
- “সাথে” মূলত হিন্দি “साथ” (সাথ) শব্দ থেকে বাংলায় প্রবেশ করেছে।
- বাংলার ব্যাকরণ বা মান্য অভিধানে এটি স্বীকৃত নয়, তবে কথ্য রূপে প্রচলিত।
২. ধ্বনিগত ও ছন্দগত দিক
- “সঙ্গে” শব্দে দুটি ব্যঞ্জন-সংযোগ (ঙ্+গে) থাকায় উচ্চারণ কিছুটা জটিল।
- সাধারণ কথায় সহজতার কারণে তা “সাথে” হয়ে যায়।
- কবিতা ও গানে “সাথে” ব্যবহার হলে ছন্দ ও মাত্রার দিক থেকে সুবিধা হয়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
- বাংলা ভাষার ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, কথ্য রূপের প্রভাব লেখ্য ভাষার উপর পড়েছে।
- প্রাচীন বাংলার চর্যাপদ-এ সংস্কৃত ঘেঁষা শব্দ থাকলেও পরে তা সহজ রূপ নেয়।
- মধ্যযুগে মুসলিম শাসনের সময় ফারসি-আরবি শব্দ প্রবেশ করে।
- ঔপনিবেশিক যুগে ইংরেজি শব্দ বাংলায় ঢুকে পড়ে।
- আধুনিক যুগে হিন্দি-হিন্দুস্তানি ভাষার প্রভাবে “সাথে” শব্দ বাংলায় প্রবলভাবে ঢুকে পড়েছে।
- অনেকেই শুদ্ধ রূপ না জেনে ভুল রূপ ব্যবহার করছেন।
সমাজভাষাবিজ্ঞানের প্রেক্ষাপট
১. প্রবাসী বনাম দেশীয় ব্যবহার
প্রবাসী বাঙালিরা মাতৃভাষা নিয়ে বেশি আবেগপ্রবণ হন। বিদেশে থেকে ভাষা টিকিয়ে রাখা তাদের কাছে সাংস্কৃতিক দায়। তাই পার্থ ভট্টাচার্যের মতো উদ্যোগ প্রবাসীদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়।
২. কথ্য বনাম লিখিত রূপ
ভাষাতত্ত্বে বলা হয়, কথ্য ভাষা সবসময় দ্রুত পরিবর্তিত হয়, অথচ লিখিত ভাষা স্থিতিশীল থাকে। তাই “সাথে” কথ্য রূপে জনপ্রিয় হলেও মান্য লেখ্য রূপ হিসেবে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
৩. জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রভাব
সিনেমা, গান ও টেলিভিশনে “সাথে” শব্দ বেশি ব্যবহৃত হওয়ায় তা জনসাধারণের ভাষায় গেঁথে গেছে। বিশেষত বলিউডের প্রভাব এখানে প্রবল।
অস্তিত্ব সংকট ও ভাষা-শুদ্ধি আন্দোলন
- বাংলা ভাষা বর্তমানে যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—
- ইংরেজি প্রভাব: শিক্ষিত সমাজে বাংলা বাদ দিয়ে ইংরেজি ব্যবহারের প্রবণতা।
- হিন্দি প্রভাব: টিভি ও সিনেমার মাধ্যমে হিন্দি শব্দের অনুপ্রবেশ।
- ডিজিটাল যোগাযোগ: হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতিতে অশুদ্ধ বানান ব্যবহারের অভ্যাস।
- তরুণ প্রজন্মের অবহেলা: অনেকে মনে করেন, শুদ্ধ বানান জানার প্রয়োজন নেই।
এই প্রেক্ষাপটে “সাথে নয়, সঙ্গে বলুন” আন্দোলন আসলে ভাষা-শুদ্ধি আন্দোলনের ক্ষুদ্র হলেও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ভাষার শুদ্ধতা মানে শুধু নিয়ম নয়, বরং সাংস্কৃতিক মর্যাদা রক্ষা।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত
- ফ্রান্স: ফরাসি ভাষা রক্ষার জন্য সরকার Académie Française গঠন করেছে।
- আইসল্যান্ড: বিদেশি শব্দ এড়িয়ে নিজের শব্দ উদ্ভাবনের নীতি।
- বাংলাদেশ: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জনের অনন্য উদাহরণ।
- এই দৃষ্টান্তগুলি প্রমাণ করে—ভাষার শুদ্ধি কেবল ব্যাকরণের বিষয় নয়, বরং জাতীয় পরিচয়ের প্রশ্ন।
উপসংহার ও সুপারিশ
বাংলা ভাষার সম্মান ও মর্যাদা বজায় রাখতে হলে “সঙ্গে” শব্দকেই মান্য রূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন—
- শিক্ষাব্যবস্থা: প্রাথমিক স্তর থেকেই শুদ্ধ বানান শিক্ষা।
- গণমাধ্যম: সংবাদপত্র, টিভি ও রেডিওতে শুদ্ধ রূপ প্রচলন।
- প্রযুক্তি: মোবাইল ও কম্পিউটার কিবোর্ডে শুদ্ধ বানান সাজেশন।
- সাহিত্য ও শিল্পী সমাজ: লেখক, কবি ও গায়ক-গায়িকাদের শুদ্ধ শব্দ ব্যবহারে সচেতনতা।
- প্রবাসীদের ভূমিকা: প্রবাসী সমাজ থেকে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় উদ্যোগ।
- “সাথে নয়, সঙ্গে বলুন” কেবল একটি ব্যানার নয়, এটি বাংলা ভাষার প্রতি এক গভীর ভালোবাসার প্রকাশ।
তথ্যসূত্র
সুকুমার সেন (১৯৯১). বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত
হরিদাস পালিত (২০০৫). বাংলা ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্ব
সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় (১৯৬৩). Origin and Development of the Bengali Language
পবিত্র সরকার (২০১১). বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি
গৌতম ভাদুড়ি (২০১৬). ভাষার সমাজতত্ত্ব
Académie Française (2015). Official Reports on Language Preservation
Haugen, Einar (1972). The Ecology of Language. Stanford
Crystal, David (2000). Language Death. Cambridge
সংবাদপত্র প্রবন্ধ: সাথে নয়, সঙ্গে বলুন – আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০২৩
সম্পাদনা, সাংবাদিকতা, এবং সৃজনশীল লেখায় প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা নিয়ে অদিতি এক উদীয়মান সাহিত্যিক কণ্ঠ। বাংলা সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং সুগভীর প্রতিভার অধিকারী এক তরুণ লেখিকা। বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করে, নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকা, ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল এবং সংকলনে তার লেখা প্রকাশ হয়েছে। তার লেখা একক বই এবং সম্পাদিত সংকলন কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে, তার “মৃত্যু মিছিল” বইটি পাঠকমহলে বেশ জনপ্রিয়। তার সৃষ্টিশীলতার প্রসার ঘটেছে আকাশবাণী এবং ফ্রেন্ডস এফএম-এ, যেখানে তার লেখা সম্প্রচারিত হয়েছে। অদিতির মতে, "বইয়ের থেকে পরম বন্ধু আর কেউ হয় না," এবং এই বিশ্বাস তাকে সাহিত্য জগতে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে চলেছে। বর্তমানে তিনি “বিশ্ব বাংলা হাব” -এ লেখক পদে কর্মরত।